বিশ্ব পুরুষ দিবস (২০২০)
===================
- মেয়েদের মত এমন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস না তো। আর ভাল লাগছে না কিন্তু। আর কতদিন এভাবে মনমরা হয়ে থাকবি? ছাড়, অনেক হয়েছে। যে শালা তোর মত ছেলেকে চিনল না, তার জন্য তুই কিনা সব ছেড়েছুড়ে শুধু কেঁদেই যাবি?
কথাগুলো বলেছিল অর্নব, আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে এক স্কুলে পড়া, একই কলেজ, একই স্ট্রিম, খুব কাছের বন্ধু। তখন সদ্য ১৮ ছুঁয়েছি। ভালোবেসেছিলাম। ৫ বছর ধরে একই ব্যাচে পড়া একটি মেয়েকে। কথা হয়নি কখনও, শুধুই দেখা আর ভাবতে থাকা। সে জানতও না। বলা হয়ে ওঠেনি কখনও।
হ্যাঁ, আমরা পুরুষেরাও ভালোবেসে কাঁদি। বলতে না পারার যন্ত্রনায় কাঁদি। পেয়ে হারানোর যন্ত্রনায় কাঁদি। আর ওই যে "মেয়েদের মত" শব্দটা বলেছিল, আজ আমার তাতে খুব আপত্তি। ওই শব্দটায় মেয়েদের খুব ছোট করা হয়, অপমান করা হয়। তখন হয়ত না বুঝেই বলেছিল, এতটা গভীরে বোঝার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না তখন। আজও কি সবার আছে?
না, আমরা সবাই বুঝি না। পুরুষ ও নারী, তফাৎ শুধু Biological. সত্ত্বা একটি, Human Being. শুধু শরীর পুরুষ আর নারীর। প্যান্টের ভিতরে কী আছে, তার ভিত্তিতে শুধুমাত্র বাথরুম আর বেডরুম আলাদা করা যেতে পারে, বাকি সর্বত্র তারা সমান। অন্তত, সমান হওয়া উচিত। তাই ছেলেদের কান্নাকে মেয়েদের মত বলে নারী পুরুষ দুজনকেই অপমান করতে হয়না।
কথায় বলে, মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা। ছোটবেলা থেকে মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তুই না ছেলে! তোর আবার কষ্ট কিসের? তোকে তো এটা পারতেই হবে। পড়াশুনা করে বড় হতেই হবে, চাকরি পেতেই হবে, উপার্জন করতেই হবে, বাবা মাকে দেখাশোনা করতেই হবে, যদি একসন্তানকে বিয়ে করে থাকো, আজ না হোক কাল, তাদের দেখাশোনা করতেই হবে, স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব নিতেই হবে, সবার প্রয়োজন মেটাতে হবে। কত? আর কত?
যে ছেলেটা প্রাইভেট চাকরিতে টার্গেট পূরন করতে না পেরে বসের বকুনি খায় এভাবে -
- কী মিস্টার বিশ্বাস, এত পুওর পারফরম্যান্স! কাল তো অফিসেও আসেননি? কেন?
- স্যার, মিসেসের শরীর খারাপ, বাড়িতে ছোট বাচ্চা....
কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে আসে -
- তাহলে বাড়ি গিয়ে মিসেসের আঁচলের তলায় গিয়ে রেস্ট নিন।
সেই মুহূর্তে ছেলেটির মনে হয়েছে, জুতিয়ে বসের মুখ লম্বা করে দেয়। মনে হয়েছে, রেজিগনেশন লেটার টি মুখের উপর ছুঁড়ে বলে,
- রইল তোর বালের চাকরি।
( এখানে বা.. লিখে ডট ডট দিলাম না, সকলের পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত শব্দ, লুকোনোর কিছু নেই)
কিন্তু অসুস্থ স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর বর্তমানে চাকরির বাজারের অবস্থা তার অজানা নয়। তাই হাসিমুখে বলে,
- আর এমন হবেনা স্যার। দেখবেন, আর হবে না।
মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। কান্না পায়, প্রবল ভাবে কান্না পায়, নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুকে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না। কথা দিয়ে এসেছে, ফেরার সময় স্ত্রীর ওষুধ আর বাচ্চার খাবার নিয়ে ফিরবে।
কত পুরুষ প্রতিনিয়ত এভাবে মুখ বুজে অপমানিত হয়, তার হিসেব কে রাখে।
পরিসংখ্যান বলছে, নিজের বাড়ি ছাড়া মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। মেয়েরা সামাজিক নিয়মে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে বাবার বাড়ি ছেড়ে যায়। বাবা মায়ের থেকে physically দূরে থাকে। আর কত পুরুষ যে একই বাড়িতে থেকেও, একই ছাদের নীচে থেকেও বাবা মায়ের সাথে লুকিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়, সে হিসেব কজন রাখে। বহু পুরুষ তার নিজের উপার্জন থেকে তার বাবা মায়ের দেখাশোনা পর্যন্ত করতে পারে না। পুরুষ প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হয়, তার নিজের পরিবারেই। বাইরের জগৎ ছেড়েই দিলাম।
পরিসংখ্যান বলছে, ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। হবে না-ই বা কেন। ঘরে বাইরে বোকার হদ্দের মত এত চাপ কে সামলায়। আমার তো পুরুষদের কলুর বলদ বলে মনে হয়। শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর যন্ত্র। তাতেই খুশি। আমার স্ত্রী, আমার সন্তান, আমার ঘরবাড়ি, নে শালা খেটে মর। কিচ্ছু তোর না। যেদিন বুঝবি, সোজা ডিপ্রেশনের 2nd stage পার হয়ে যাবে।
পরিসংখ্যান বলছে, সুইসাইড করা মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। ওই যে বললাম, চাপ নিতে নিতে আর পূরণ করতে করতে যখন হাফিয়ে ওঠে, সবার চাহিদার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আর যখন পারে না, নিজের সাথে লড়তে লড়তে হেরে যায়, ব্যাস, লে ভগবান, মুঝে উঠা লে বলে ঝুলে পড়ে। কাহানি খতম।
পরিসংখ্যান বলছে, গৃহহীন মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। অপরাধপ্রবন মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। জেলে যাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। নির্যাতনের নিরিখে পুরুষের সংখ্যা বেশি। এটা পরিসংখ্যান বলে না। তার যথাযথ রেকর্ড নেই।
আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করি। নিত্য অফিস যাতায়াতের পথে দেখি, ট্রেন যাত্রী পুরুষদের দেখি, ৪০ পার করা অধিকাংশ পুরুষ বিমর্ষ, প্রানহীন, উৎসাহহীন, যেন চলতে হয় তাই চলছে। শরীরকে টেনে নিয়ে চলছে, মাথায় বিরাট কিছু দায়িত্বভার নিয়ে। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক। পারিবারিক বিবাদ সামলাতে হয় না, এমম পুরুষ বিরল এবং তারা অবশ্যই সৌভাগ্যবান। স্ত্রী ও মায়ের মাঝে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হতে হয়না, বা হতে হয়নি, এমন পুরুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা ভাল থাকবে কীভাবে? এই মানসিক নির্যাতনের কোনও রেকর্ড নেই। তাহলে সব রেকর্ড এক নিমেষেই ব্রেক হত।
এত সব সয়েও তাদের বাইরে হাসি মুখে, মন শক্ত রেখে, অসীম সহ্যশক্তির প্রমান দিয়ে পরিবারকে চালাতে হয়, তাদের আর প্রানোচ্ছাস থাকবে কোথা থেকে। জীবনকে পড়ার, বোঝার আর ব্যালেন্স করে চালানোর ক্ষমতা সবার সমান হয় না। তাই অনেকে হেরে যায়, অনেকে হারিয়ে যায়।
তাই সবার সব দিবস ঘটা করে উদযাপিত হলে পুরুষ দিবস যেন উপেক্ষিতই থেকে যায়, বরাবর ঠিক যেভাবে পুরুষের মন, আবেগ, যন্ত্রণা, কষ্ট, কান্না, লজ্জা, গ্লানি, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণও উপেক্ষিত থেকে এসেছে বরাবর। হ্যাঁ, মানতে শিখুন, বিশ্বাস করতে শিখুন, পুরুষেরাও ধর্ষিত হয়।
আজ তাই আমার জীবন জুড়ে, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ও বিশ্বজুড়ে যত পুরুষ, তাদের সবার জন্য ভালোবাসা রইল। ভাল থাকুক সকল ছেলেরা, ভাইয়েরা, দাদারা, বাবারা, স্বামীরা, দাদুরা।
আসলে চাই, সকল মানুষ ভাল থাকুক। আজ পুরুষের দিন, তাই শুধু পুরুষের কথাই লিখলাম।
ধন্যবাদ।
শুভরাত্রি।