Thursday, November 19, 2020

বিশ্ব পুরুষ দিবস।

বিশ্ব পুরুষ দিবস (২০২০)
===================

- মেয়েদের মত এমন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস না তো। আর ভাল লাগছে না কিন্তু। আর কতদিন এভাবে মনমরা হয়ে থাকবি? ছাড়, অনেক হয়েছে। যে শালা তোর মত ছেলেকে চিনল না, তার জন্য তুই কিনা সব ছেড়েছুড়ে শুধু কেঁদেই যাবি?  

কথাগুলো বলেছিল অর্নব, আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। একসাথে এক স্কুলে পড়া, একই কলেজ, একই স্ট্রিম, খুব কাছের বন্ধু। তখন সদ্য ১৮ ছুঁয়েছি। ভালোবেসেছিলাম। ৫ বছর ধরে একই ব্যাচে পড়া একটি মেয়েকে। কথা হয়নি কখনও,  শুধুই দেখা আর ভাবতে থাকা। সে জানতও না। বলা হয়ে ওঠেনি কখনও।  

হ্যাঁ, আমরা পুরুষেরাও ভালোবেসে কাঁদি। বলতে না পারার যন্ত্রনায় কাঁদি। পেয়ে হারানোর যন্ত্রনায় কাঁদি। আর ওই যে "মেয়েদের মত" শব্দটা বলেছিল, আজ আমার তাতে খুব আপত্তি। ওই শব্দটায় মেয়েদের খুব ছোট করা হয়, অপমান করা হয়। তখন হয়ত না বুঝেই বলেছিল, এতটা গভীরে বোঝার ক্ষমতা আমাদের কারোরই ছিল না তখন। আজও কি সবার আছে? 

না, আমরা সবাই বুঝি না। পুরুষ ও নারী,  তফাৎ  শুধু Biological.  সত্ত্বা একটি, Human Being. শুধু শরীর পুরুষ আর নারীর।  প্যান্টের ভিতরে কী আছে, তার ভিত্তিতে শুধুমাত্র বাথরুম আর বেডরুম আলাদা করা যেতে পারে, বাকি সর্বত্র তারা সমান। অন্তত,  সমান হওয়া উচিত। তাই ছেলেদের কান্নাকে মেয়েদের মত বলে নারী পুরুষ দুজনকেই অপমান করতে হয়না। 

কথায় বলে, মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা। ছোটবেলা থেকে মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তুই না ছেলে!  তোর আবার কষ্ট কিসের?  তোকে তো এটা পারতেই হবে। পড়াশুনা করে বড় হতেই হবে, চাকরি পেতেই হবে, উপার্জন করতেই হবে, বাবা মাকে দেখাশোনা করতেই হবে, যদি একসন্তানকে বিয়ে করে থাকো, আজ না হোক কাল, তাদের দেখাশোনা করতেই হবে, স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব নিতেই হবে, সবার প্রয়োজন মেটাতে হবে। কত? আর কত? 

যে ছেলেটা প্রাইভেট চাকরিতে টার্গেট পূরন করতে না পেরে বসের বকুনি খায় এভাবে - 
- কী মিস্টার বিশ্বাস, এত পুওর পারফরম্যান্স!  কাল তো অফিসেও আসেননি?  কেন?  
- স্যার, মিসেসের শরীর খারাপ, বাড়িতে ছোট বাচ্চা.... 

কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে আসে - 

- তাহলে বাড়ি গিয়ে মিসেসের আঁচলের তলায় গিয়ে রেস্ট নিন। 

সেই মুহূর্তে ছেলেটির মনে হয়েছে, জুতিয়ে বসের মুখ লম্বা করে দেয়। মনে হয়েছে, রেজিগনেশন লেটার টি মুখের উপর ছুঁড়ে বলে, 

- রইল তোর বালের চাকরি।  

( এখানে বা..  লিখে ডট ডট দিলাম না, সকলের পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত শব্দ,  লুকোনোর কিছু নেই)  

কিন্তু অসুস্থ স্ত্রী,  সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর বর্তমানে চাকরির বাজারের অবস্থা তার অজানা নয়। তাই হাসিমুখে বলে,  

- আর এমন হবেনা স্যার। দেখবেন, আর হবে না। 

মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। কান্না পায়, প্রবল ভাবে কান্না পায়, নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুকে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না। কথা দিয়ে এসেছে, ফেরার সময় স্ত্রীর ওষুধ আর বাচ্চার খাবার নিয়ে ফিরবে। 

কত পুরুষ প্রতিনিয়ত এভাবে মুখ বুজে অপমানিত হয়, তার হিসেব কে রাখে। 

পরিসংখ্যান বলছে,  নিজের বাড়ি ছাড়া মানুষের  মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  মেয়েরা সামাজিক নিয়মে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে বাবার বাড়ি ছেড়ে যায়। বাবা মায়ের থেকে physically দূরে থাকে। আর কত পুরুষ যে একই বাড়িতে থেকেও, একই ছাদের নীচে থেকেও বাবা মায়ের সাথে লুকিয়ে কথা বলতে বাধ্য হয়, সে হিসেব কজন রাখে। বহু পুরুষ তার নিজের উপার্জন থেকে তার বাবা মায়ের দেখাশোনা পর্যন্ত  করতে পারে না। পুরুষ প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হয়, তার নিজের পরিবারেই। বাইরের জগৎ ছেড়েই দিলাম।  

পরিসংখ্যান বলছে, ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  হবে না-ই বা কেন। ঘরে বাইরে বোকার হদ্দের মত এত চাপ কে সামলায়। আমার তো পুরুষদের কলুর বলদ বলে মনে হয়। শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর যন্ত্র।   তাতেই খুশি।  আমার স্ত্রী,  আমার সন্তান,  আমার ঘরবাড়ি,  নে শালা খেটে মর। কিচ্ছু তোর না। যেদিন বুঝবি, সোজা ডিপ্রেশনের 2nd stage পার হয়ে যাবে। 

পরিসংখ্যান বলছে, সুইসাইড করা মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  ওই যে বললাম, চাপ নিতে নিতে আর পূরণ করতে করতে যখন হাফিয়ে ওঠে, সবার চাহিদার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আর যখন পারে না, নিজের সাথে লড়তে লড়তে হেরে যায়, ব্যাস, লে ভগবান, মুঝে উঠা লে বলে ঝুলে পড়ে। কাহানি খতম।

পরিসংখ্যান বলছে, গৃহহীন মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। অপরাধপ্রবন মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  জেলে যাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  নির্যাতনের নিরিখে পুরুষের সংখ্যা বেশি।  এটা পরিসংখ্যান বলে না। তার যথাযথ রেকর্ড নেই। 

আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য  করি। নিত্য অফিস যাতায়াতের পথে দেখি, ট্রেন যাত্রী পুরুষদের দেখি, ৪০ পার করা অধিকাংশ পুরুষ বিমর্ষ,  প্রানহীন, উৎসাহহীন, যেন চলতে হয় তাই চলছে। শরীরকে টেনে নিয়ে চলছে, মাথায় বিরাট কিছু দায়িত্বভার নিয়ে। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক। পারিবারিক বিবাদ সামলাতে হয় না, এমম পুরুষ বিরল এবং তারা অবশ্যই সৌভাগ্যবান।  স্ত্রী ও মায়ের মাঝে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হতে হয়না, বা হতে হয়নি, এমন পুরুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  তারা ভাল থাকবে কীভাবে? এই মানসিক নির্যাতনের কোনও রেকর্ড নেই। তাহলে সব রেকর্ড এক নিমেষেই ব্রেক হত। 

এত সব সয়েও তাদের বাইরে হাসি মুখে, মন শক্ত রেখে, অসীম সহ্যশক্তির প্রমান দিয়ে পরিবারকে চালাতে হয়, তাদের আর প্রানোচ্ছাস থাকবে কোথা থেকে। জীবনকে পড়ার, বোঝার আর ব্যালেন্স করে চালানোর ক্ষমতা সবার সমান হয় না। তাই অনেকে হেরে যায়, অনেকে হারিয়ে যায়। 

তাই সবার সব দিবস ঘটা করে উদযাপিত হলে পুরুষ দিবস যেন উপেক্ষিতই থেকে যায়, বরাবর ঠিক যেভাবে পুরুষের মন, আবেগ, যন্ত্রণা,  কষ্ট,  কান্না, লজ্জা, গ্লানি,  নির্যাতন,  এমনকি ধর্ষণও উপেক্ষিত থেকে এসেছে বরাবর। হ্যাঁ, মানতে শিখুন, বিশ্বাস করতে শিখুন, পুরুষেরাও ধর্ষিত হয়। 

আজ তাই আমার জীবন জুড়ে, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র,  ও বিশ্বজুড়ে যত পুরুষ,  তাদের সবার জন্য ভালোবাসা রইল। ভাল থাকুক সকল ছেলেরা, ভাইয়েরা, দাদারা, বাবারা, স্বামীরা, দাদুরা। 

আসলে চাই, সকল মানুষ ভাল থাকুক। আজ পুরুষের দিন, তাই শুধু পুরুষের কথাই লিখলাম। 

ধন্যবাদ। 
শুভরাত্রি।

Wednesday, November 18, 2020

সপ্তম বিবাহবার্ষিকী ২০২০

সপ্তম বিবাহবার্ষিকী (  ২০২০) 
=====================

অসাধারণ সুন্দর ভাবে কাটালাম এবারের বিবাহবার্ষিকী।  যেটা সবাই করে, সেটা সাধারন, আর যেটা প্রায় কেউ করে না, করার কথা ভাবেও না, সেটা অসাধারণ।  আমারটিও তাই -ই। কেউ কেক,  ফুল, মিষ্টি নিয়ে, দুজন দুজনকে গিফট দিয়ে এই দিন পালন করে আবার কেউ বা কোথাও বেড়াতে গিয়ে দিনটি উদযাপন করে।  মানে বিশেষ কিছু একটা করে, মনে রাখার মত। আর আমি যেভাবে কাটালাম, তাতে যে কোনও স্বামী,  বৌএর হাতে মার খাবে। আমি সব দিনক্ষণ ভুলেই গেছি। মাথায় ছিল ১৪ থেকে ১৭ তারিখ অফিস ছুটি, ১৮ তারিখে অফিস খুলে আবার ৪ দিন ছুটি, সেই ২৩ তারিখ অফিস খুলবে। তাই ১৮ তারিখ অফিস যেতেই হবে, করোনা পরিস্থিতি,  অফিসের ইনচার্জ পরিবর্তন,  স্টাফের শ্বশুর মশাইয়ের মৃত্যু ও সেই কারনে তার অফিসে না আসতে পারা, সব মিলিয়ে মাথায় শুধু অফিসই চেপে ছিল। এখন স্টাফ মাত্র তিনজন  ও এক অফিসার, সেও আবার নতুন, তার সাথে একদিন মাত্র কথা হয়েছে, এবং সে করোনা আক্রান্ত, আসবে কিনা জানা নেই, এমন অবস্থায় মাথায় অফিস ছাড়া কিছুই ছিল না। 

তাই কাল মানে মঙ্গলবার রাতে ওকে বলে রাখি, কাল সকালে তাড়াতাড়ি ডেকে দিও, অফিস আছে, দেরি করলে ট্রেন পাবনা। এতদিন না হয় বাইকে গেছি নিজের মত করে,  একসময় বেরোলেই হল। ও রাতে বলল, 
- কাল অফিস না গেলে হয়না? 
- তা কী করে হয়? যেতে হবে।  
- আর কেউ নেই?  
- আমি ছাড়া কে যাবে?  তুমি তো সব জানো। 

ও আমার অফিস সংক্রান্ত সব কিছু জানে আর সবাইকে চেনেও, আমার গল্প করার সাথী ও আর মেয়ে। আর ফোনে বাবা,  মা। ও আবার বলল, 
- সব দায় কী তোমার?  
- দায় নয়, যেতে হবে, সবাই নানা অসুবিধার মধ্যে আছে। কাউকে তো সামলাতেই হয়, সে না হয় আমিই গেলাম। 
- যাও, কী আর বলব। 

ব্যাস, ওর রাগ হয়ে গেল। সব বুঝেও রাগ করবে। আমি চুপ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু অভ্যাস এমন হয়ে গেছে, ২ টোর আগে ঘুম আসেনা, আর সকাল ১০ টার আগে ঘুম ভাঙে না। এমন না যে জেগে শুয়ে থাকি ইচ্ছে করে, তা কিন্তু নয়।  অফিস থাকলে জোর করে উঠতে হয়। যাইহোক,  ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। তখন আমার বিন্দুমাত্র মনে নেই, কাল বিবাহবার্ষিকী।  ১৮ তারিখ মনে আছে। তার সাথে যুক্ত ঘটনা গুলো মনে নেই। 

ও রাতে বসে ভিডিও এডিট করছিল। দুদিন আগে আমার থেকে শিখেছে,  নানা জায়গায় আটকে যায়। রাত তখন প্রায় ১ টা। আমি প্রায় ঘুমিয়েছি। ও বলল, 
- আমি এটুকু জায়গায় মিউজিক অ্যাড করতে চাই। কেমন করে করব?  

ঘুমটা ভেঙে গেল। কোনও রকমে ঘুমের চোখে বলে দিলাম, এই এই কর, হয়ে যাবে। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে, 

- আমি এইটুকু জায়গায় কথাটা বন্ধ করতে চাই, কিভাবে করব? 

আবার গেল ঘুমটা কেটে। 
- যেখান থেকে অফ করতে চাও, তার আগে পরে split করে মাঝের audio off করে দাও। 

বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।  

কিছুক্ষণ পরে আবার, পুরো ক্লিপের এইটুকু জুম  করতে চাই। দেখো, ঠিক এইটুকু।  

এবার গেলাম রেগে, প্রকাশ নেই, বললাম নিয়ে আস দেখি। 
- সামনে পেছনে split দাও, মাঝের টুকু select করে pan & zoom এ গিয়ে করে নাও। 

বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। এগুলো সব ওকে আগেও দেখিয়েছি, জানি সড়গড় হতে সময় লাগবে। কিন্তু আমার মাথায় ছিল, কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। তাই ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম।  রাত প্রায় ২ টো তখন,  

- Description এ কী লিখব, বলবে?  
- হু?  
- বলছি, upload হয়ে গেছে, description এ কী লিখব, বলবে? 

রাগের না হয় প্রকাশ নেই, কিন্তু কথা বলার ধরন গেছে পালটে, সেভাবেই বললাম, 
- ভিডিও তে যা যা আছে, সেগুলোই সংক্ষেপে লিখে দাও। ব্যাস। 

এটা একটু জোরে করে বলা হল। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।  

কিছুক্ষন পরে,  

- ট্যাগ কী দেব, বলবে?  
- তুই রাখতো তোর ভিডিও। কাল সকালে করিস। ঘুমোতে দে। আগের গুলো দেখে নে। 

এই বলে একেবারে কম্বল চাপা দিলাম।  

সকাল ৮ টায় ঘুম থেকে উঠে বাইরে যেতেই ওর মুখোমুখি,  ও বলল, 

- আমি তোর উপর রাগ করি। 
- কেন রে?  
- কাল তুই আমার উপর খুব খ্যাট খ্যাট করেছিস। 
- কোথায় করলাম, সব তো ভাল করেই বলে দিলাম। 
- আমি সব বুঝি। 
- বুঝেছিস, ভাল করেছিস, তোকে ফার্স্ট প্রাইজ দেওয়া হবে। 
- ইয়ার্কি করবি না একদম। 
- জলটল ভরেছ গো। 
- সব রেডি আছে, যা। 

ওর মুখ ভার। আমার তখনও মনে হয়নি আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।  মনেই নেই। 

আমি তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়াদাওয়া করে নিলাম আর ও আমার সাথে তাল দিয়ে সব কিছুর যোগান দিতে থাকল, যেমনটি করে আসছে ৭ বছর ধরে। ৯টা ১০ এ ট্রেন, আমি ৯ টা ৪ এ বাইক স্টার্ট দিলাম, আবার টিকিট কাটতে হবে, রোজ যেহেতু অফিস নেই, মান্থলি দরকার হয়না, আবার UTS App ও কাজ করছে না, তাই online এ কাটতে পারছি না। অসুবিধা হল না, কম লোক থাকায় সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। 

এবারে ট্রেনে উঠে অভ্যাসের কারনে ফেসবুক খুললাম, তিন বছর আগের করা আমার পোস্ট ভেসে এল। তখন বুঝলাম, ওরে বাবা, আজ যে আমাদের বিবাহবার্ষিকী। যাইহোক,  ছবিগুলো দেখলাম, খারাপ লাগছিল না। 

যথারীতি অফিস করে সন্ধ্যা ৬ টায় বাড়ি ফিরে স্নান করে খেয়েদেয়ে এটা লিখতে বসলাম। তার আগেই দেখেছি, ফেসবুকে ও আমার সেই তিনবছর আগের পোস্ট শেয়ার করেছে। ট্রেনে আসতে আসতে ভাবছিলাম, আজ ও নিশ্চয়ই আমার জন্য বিশেষ কিছু বানিয়ে রাখবে। যেমনটি ওর অভ্যাস আর কি। খেতে বসে দেখি, ওমা, ভাত, পোনা মাছের ঝোল, আলুসিদ্ধ,  আর ডিমভাজা। আমি বললাম, 

- কীরে বুড়ো, আজ এমন নিরামিষ খাওয়াদাওয়া যে?  
- কোথায় নিরামিষ দেখলি? 
- এগুলোকে আবার নিরামিষ ছাড়া কী বলব?  
- ভাল খেতে খেতে তোর গলা হাই রেঞ্জে চলে গেছে। 
- হ, তোরে কইসে। 
- তাহলে তুই মাছ, ডিমভাজা কে নিরামিষ দেখিস কোন চোখে?  
- এই সব মাছ এখন নিরামিষ বলেই মনে হয়। 
- নে, আজ একটু কষ্ট করে খেয়ে নে, কাল ভাল কিছু বানিয়ে দেব। মাংস আনতে গিয়েছিলাম রে, তখন ছিল না। 

খেতে খেতেই রাজু দার ( আমার জামাইবাবু)  সাথে কথা হয়, ভিডিও কলে। বাবা, মা'র সাথেও কথা হল। ব্যাস দিন শেষ।  আর এখন ও বসে বসে ভিডিও এডিট করছে আর আমি লিখছি। মেয়ে ৮ টার সময় ঘুমিয়ে পড়েছে। 

এতটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 
শুভরাত্রি।

পুনশ্চঃ - এই লেখাটি upload এর পরে ও পড়ে খুব হাসল পাঁচ মিনিট ধরে, আমিও বিশাল হাসলাম। বলল, কী সব লিখেছিস?  আমি বললাম, তোর স্বামী তো শালা ঔপন্যাসিক,  তুই জানিস না?  তোর স্বামী তো মেলাকিছু। 
আবার একপ্রস্ত হাসাহাসি। 


Saturday, August 8, 2020

এভাবে ভালো থাকা যায়?

এই লেখাটি রইলো ....

এভাবে ভাল থাকা যায়? 

যে ছেলেটি সদ্য আঠারো বছর পার করেছে, যার দুচোখ জুড়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল, যে গীটার নিয়ে গান গেয়ে কলেজ মাতিয়ে রাখত, যার জীবন বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল, সে কী ভাল থাকতে পারে? যে বাবা মা তাদের অসুস্থ সন্তানকে বাঁচানোর জন্য দিনভোর ঘুরে বেড়ায় এ হাসপাতাল থেকে সে হাসপাতাল, ব্যর্থ হয় প্রতি দরজায়, যে বাবা মা সন্তানের চিকিৎসার জন্য আত্মহত্যার হুমকি দিতে বাধ্য হয়, এত কিছুর পরেও যে বাবা মা তাদের সন্তানকে বাঁচাতে পারেন না,  তারা কী ভাল থাকতে পারেন? পারেন না, পৃথিবীর কোনও বাবা মা-ই এভাবে ভাল থাকতে পারেন না। এভাবে ভাল থাকা যায় না। 
যে মানুষটি সারাজীবনের প্রবল অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের ভিত্তিতে সাফল্যের চূড়া ছুঁতে চেয়েছিল, যে মানুষটি শত বাধা বিপত্তি সত্বেও তার কর্তব্য ও নিষ্ঠায় অবিচল ছিল, সে যখন তার চার বছরের সন্তানকে একলা করে, সবাইকে নিঃস্ব করে চলে যায়, সে কী ভাল থাকতে পারে? যে শিশুটি জানেই না মৃত্যু কী, যে শিশুটি জানেই না, তার মা আর কখনও ফিরবে না, সে কী ভাল থাকতে পারে। না , পারে না। পৃথিবীর কোনও শিশু এভাবে ভাল থাকতে পারে না। এভাবে ভাল থাকা যায় না। 

যে ছেলেটি তার স্ত্রী সন্তানকে কথা দিয়ে গিয়েছিল, এবার তিনমাস পরেই বাড়ি ফিরে আসবে, বলে গিয়েছিল, তোমার জন্য গয়না নিয়ে আসব, বাচ্চাদের বলে গিয়েছিল, তোমাদের জন্য অনেক খেলনা নিয়ে আসব, তোমরা কিন্তু একদম কাঁদবে না। ছেলেটি কথা রাখতে চেয়েছিল, তাই রাজপথ ধরে হাঁটতে শরু করেছিল মাইলের পর মাইল। দিন গিয়ে রাত হয়েছে, রাত গিয়ে দিন হয়েছে, অভুক্ত নিদ্রাহীন শরীরটি কথা রাখতে পারেনি। তার সন্তানেরা পথ চেয়ে ছিল, বাবা খেলনা নিয়ে ফিরবে, না, তার বাবা আর ফেরেনি। আজও শিশুটি পথ চেয়ে থাকে, বাবা কেন ফিরল না। এভাবে কী কোনও বাবা ভাল থাকতে পারে? পারে না, এভাবে ভাল থাকা যায় না। 

ছাব্বিশ বছরের যে ছেলেটি, তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল, রঙের কাজ নিয়ে গিয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ। বাড়ির মানুষের হাতে টাকা ছিল না, সে ফিরছিল রেল লাইন ধরেই, তার বন্ধুদের সাথে। ভেবেছিল, সে  বাড়ি ফিরলে অন্ততঃ সবাই মিলে ডাল ভাত খেয়ে বাঁচতে পারবে। কখন যে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিল রেল লাইনের উপরেই। না , তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। তার উপার্জনহীন পরিবার, প্রায় অনাহারে বেঁচে আছে। এভাবে কি কে ভাল থাকতে পারে? পৃথিবীর কোনও পরিবার এভাবে ভাল থাকতে পারে না। 

বৃদ্ধ পিতামাতার একমাত্র সন্তান যে মেয়েটি সেলাইয়ের কাজ নিয়ে ভিন রাজ্যে গিয়েছিল, আজ চার মাস সে কর্মহীন হয়ে বাড়ি বসে আছে। হাতের জমানো টাকা সব শেষ। সাহায্য আর অনুদান নিয়ে বেঁচে আছে তিনটি প্রাণী। তারা জানেনা, কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।  এভাবে কি কেউ ভাল থাকতে পারে? 

অসাধারন আবৃত্তি জানা যে ২১ বছরের মেয়েটি সবেমাত্র নার্সিং ট্রনিং শেষ করে কাজে যোগ দিয়েছে, মনপ্রান দিয়ে সেবা করেছে সকলের, কখন যে সে জীবনের কাছে হেরে গেল, জানল না কেউ। শোকে পাথর তার বাবা মা, আজও পথ চেয়ে থাকে, এই বুঝি ফিরে এল। ভাল থাকা? এভাবে? হয় না। 

তিন বছরের কন্যা সন্তানকে বাড়িতে রেখে যে পুলিশ অফিসার সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে জনগনকে সামলেছে, ট্রাফিক সামলেছে, হাসপাতাল সামলেছে,  কখন যে সে নিজেকে সামলাতে ভুলে গেছে, বুঝতেই পারেনি। শিশুটি আজও অপেক্ষা করে থাকে, এই বুঝি বাবার ফোন এল। আসে না। সে তার বাবার দেওয়া টুপিটি পড়ে আনমনে বলে ওঠে, বাবা, আমিও তোমার মত পুলিশ হবো। 

সদ্য ইন্টার্নশিপ পাশ করা যে তরুন ছেলেটি কাজে যোগ দিয়েই ২৪ ঘন্টার ডিউটি পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে, হাসিমুখে গ্রহন করে সমস্ত চ্যালেঞ্জ, সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত শরীর জানতে পারে না, সে নিজেই একজন পসিটিভ। তার ভালবাসার মানুষটি অপলক চেয়ে থাকে, ছেলেটির লাস্ট মেসেজের দিকে, চিন্তা করো না, আমি ভাল আছি। এভাবে কেউ ভাল থাকতে পারে? পারেনা। 

আসলে বিশ্বজুড়ে আজ যখন অতিমারী, দিকে দিকে শুধু স্বজন হারানোর যন্ত্রনা, কাজ হারিয়ে পরিবার নিয়ে কোটি কোটি মানুষের চরম দুর্দশার সাথে দিন গুজরান, বিশ্বজুরে বেড়ে চলা দারিদ্র্য আর বেকারত্ব, পৃথিবীজুড়ে নানা পেশার মানুষের লড়াই করে মৃত্যুবরণ , অসহায়ের মত মেনে নেওয়া, এভাবে কি কে ভাল থাকতে পারে? সম্ভব না। 

 সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য, যারা এই অসম লড়াইয়ের বীর যোদ্ধা, তাদের সকলকে আমার প্রনাম।     আমরা আশাবাদী, আজও আশাবাদী, আবার সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার । এক নতুন সকাল দেখার অপেক্ষায় রইলাম। নমস্কার।

Friday, July 17, 2020

ভাল থাকুক তারা।

লেখাটি রইল ... 

যে ছেলেটি বিকেল হলেই বন্ধুদের সাথে পাড়ার মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলত, আজ সে পড়ে আছে হাজার মাইল দূরের কোনও এক বিলাসবহুল হোটেলের রান্নাঘরে। আজ সবাই জানে তার হাতে জাদু আছে, তার হাতের রান্নায় নাকি আত্মা তৃপ্তি পায়, ফরেনাররা তার রান্নার প্রশংসা করে, কেউ খোঁজ রাখে না, তার দু পায়েই জাদু ছিল। সারাদিন কাজের শেষে, ক্লান্ত শরীরে সে যখন বিছানায়, সে ফিরে যেতে চায়, তার পাড়ার ফুটবল মাঠে, তার ফেলে আসা বন্ধুদের সাথে আরও একবার চিৎকার করে বলতে চায়, দেখিস, আমরাই জিতব। কখন যে সে নিজের কাছেই হেরে বসে আছে, জানতেও পারে না। হাজার মাইল দূরের বিলাসবহুল শহরের নিঝুম রাতের তারারা জানতে পারে না, ছেলেটির মন ভালো নেই। 

যে ছেলেটি ফুলের বাগান করতে ভালোবাসত, যার বাড়ি ভর্তি নানা রঙের ফুলের বাহার, আজ সে জীবনের সব রং হারিয়ে কাজ নিয়েছে বিদেশে। তার বাগানের ফুলেরা পরিচর্যার অভাবে মাথা নত করে মৃত্যুর দিন গোনে। অপেক্ষা করে থাকে ছেলেটির ফিরে আসার পথ চেয়ে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, ছেলেটির চুক্তির মেয়াদ ফুরোয় না। কংক্রিটের অট্টালিকায় বসে ছেলেটি ফিরে পেতে চায়, তার সাজানো ফুলের বাগান, প্রজাপতির আনাগোনা। মসৃন, চকচকে দেয়ালেরা জানতে পারে না, ছেলেটির মন ভালো নেই। 

পড়াশোনায় বরাবর ভালো ছেলেটি, এইচ.এস. পাশ করার সাথে সাথে সংসারের দায় কাঁধে নিয়ে পাড়ি দেয় বিদেশে। প্রতিদিন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের নিত্য নতুন খাবারের ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে। আত্মীয় পরিজনেরা কমেন্ট করে, ভালোই আছিস বস। বন্ধুরা কমেন্ট করে, লাইফ ভাই তোরই, এনজয় করে নে। গভীর রাতে ছেলেটি বন্ধুদের প্রোফাইল দেখে,  কেউ অনার্স করছে, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং। ছেলেটির বুক ভারী হয়ে আসে। ফেসবুকের হাজার বন্ধুর কেউ জানতে পারে না, ছেলেটির মন ভাল নেই। 

যে ছেলেটি একটি দিনের জন্যও তার স্ত্রী সন্তান থেকে দূরে থাকেনি, আজ দু বছর হল, সে বিদেশে পড়ে আছে। শুধুমাত্র স্ত্রী সন্তানকে ভাল রাখার জন্য সে বুকে পাথর চাপা দিয়েছে। যে সন্তানকে সে প্রতিদিন বিকেলে  সাইকেলে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, আজ দু বছর হল, একটি বারের জন্য তাকে কোলে নিয়ে পারেনি। প্রতি রাতে ভিডিও কলে কথা হয় বাড়ির সবার সাথে, হাসি মুখে বলে ভাল আছি আমি, খুব ভাল আছি। সন্তানকে কোলে নেওয়ার চেষ্টায় মোবাইলকেই বুকে জড়িয়ে ধরে। স্মার্টফোন তার আলটিমেট স্মার্টনেস নিয়েও  জানতে পারে না , ছেলেটির মন ভাল নেই। 
বছর ১৮ এর ছেলেটি রোজ মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত। ওর মা লাঠি হাতে না দাঁড়ালে বাড়ি ফিরত না। আজ একবছর হল, ছেলেটি আর বাড়ি ফেরে না। মায়ের চোখ আজও প্রতি সন্ধ্যায় মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, ঘুড়ি আজও ওড়ে, আজও ছেলেরা আনন্দ করে খেলে বেড়ায়, শুধু তার ছেলেটি দেশ ছাড়া। আজও মা রান্না করে ছেলের কথা ভেবে, পুজো করে ছেলের মঙ্গল কামনায়। আর হাজার মাইল দূরে থাকা ছেলেটির জীবন আজ কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত। বাঁধনছাড়া। কাজের শেষে ছেলেটি আকাশ দেখে, ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে। এই বুঝি বৃষ্টি  হবে। ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজে যায়। বৃষ্টির একটি ফোঁটাও জানতে পারে না ছেলেটির মন ভাল নেই। 

আসলে যারাই নিজের শহর বা দেশ ছেড়ে কাজের জন্য বাইরে যায়, নিতান্ত বাধ্য হয়েই যায়, জীবনকে আরও একটু ভাল করার জন্য, সমৃদ্ধ করার জন্যই যায়। আর সাথে সাথে একবুক যন্ত্রনা নিয়েও যায়। নিজের গ্রাম, শহর, বন্ধু বান্ধব, পরিবার, পরিজন, বাবা মা স্ত্রী সন্তান ছেড়ে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকা কতটা কষ্টের, সেটা যারা থাকেন তারাই অনুভব করতে পারেন। তাই যারা নিজেদের পরিবারকে ভাল রাখার জন্য এতটা ত্যাগ স্বিকার করেন, তাদের সকলকে আমার ভালোবাসা। ভাল থাকুক  সেইসব ছেলেরা, ভাল থাকুক সেইসব স্বামীরা, ভাল থাকুক বাবারা। নমস্কার।

Wednesday, March 11, 2020

কথোপকথন – ২

কথোপকথন – ২ 
....................................

আজ সকালে এক আত্মীয়াকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার বিষয় ছিল, সে যাবে জিয়াগাঞ্জ আর আমি যাব ব্যারাকপুর। ঠিক করেছিলাম অফিস যাওয়ার পথে একই ট্রেনে যাব, সে কালীনারায়নপুরে নেমে যাবে আর আমি সোজা চলে যাব ব্যারাকপুর, কিন্তু বাধ সাধল আমার তিন বছরের মেয়ে। সে বলে বসল, 
- বাবা, আমিও তোমার সাথে যাব। 
কান্নাকাটির ঝামেলা না করার জন্য আমি বললাম ঠিক আছে, তাই হবে, তুমিও যাবে। যথারীতি আমরা তিনজন বাইকে যাত্রা করলাম। বুঝে গেলাম আজ আর সঠিক সময়ে অফিস যাওয়া হচ্ছে না, চারদিন পরে অফিস খুলল, তাও আবার লেট। যাইহোক, সেই আত্মীয়াকে ট্রেনে তুলে দিয়ে দিলাম।  

গল্পটি এবার শুরু। প্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটছিলাম, আমি আর মেয়ে, একটি ট্রেনের টিকিট পড়ে ছিল। লোকের পায়ে পায়ে নোংরা হয়েছে। মেয়ে বলল, 
- বাবা, এটা কী পড়ে আছে? 
- টিকিট পড়ে আছে মা। 
- কারা ফেলেছে বাবা?
- লোকেরা । 
- কোন লোকেরা বাবা?
- ঐ যারা ট্রেনে করে এখান থেকে কোথাও যায়, বা অন্য কোথাও থেকে ট্রেনে করে এখানে এসেছে, তারা। 

এবার একটু অন্যরকম প্রশ্ন, 
- লোকেরা টিকিট ভালোবাসে না, বাবা ? 
খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম, 
- হ্যাঁ, মা, বাসে তো, বাসবে না কেন? 
- তাহলে ফেলে দিয়েছে কেন? 
- আর দরকার নেই বলে। 
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। 
- দরকার না থাকলে কি ভালোবাসতে হয় না, বাবা ? 

একটু চুপ থাকলাম, বললাম, 
- হ্যাঁ, মা, দরকার না থাকলেও ভালবাসা যায়, ভালবাসতে হয়। 
ছোট্ট মানুষের সহজ প্রশ্ন, 
- তাহলে লোকেরা ওগুলো ফেলে দিল কেন? 
- ওগুলোর আর প্রয়োজন নেই মা, ওদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। 
- প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ভালোবাসতে হয় না? 
- হ্যাঁ, মা, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও ভালোবাসতে হয়।  যত্ন করতে হয়। 
ছোট্ট মানুষটি কী বুঝলো, কে জানে, সে বলল, 

- ও, তাই? 
- হ্যাঁ, তাই, মা আমার। 
আমরা প্লাটফর্ম পার করে গ্যরেজে চলে এসেছি। বাইকে মেয়েকে বসিয়ে বললাম, তুমি কিছু খাবে মা, 
- না, বাবা, বাড়ি চল, আমি তোমার সাথে স্নান করব। 

বাইক ছুটছে, মেয়ে আয়নায় মুখ দেখছে, আমার মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে, আমরা কি সত্যিই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও  ভালোবাসতে পারি? দরকার মিটে গেলেও ভালোবাসতে পারি? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। না, আমিও পারি না, পারি নি,আমার তরফ থেকেও অনেক অবহেলা আছে, যত্নের অভাব আছে, কিছুটা নিজের জগত তৈরি করে সেটাতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখে ভাল থাকার চেষ্টা আছে। আমার কাছে এগুলো ভুল বলে মনে হলেও এই অভ্যাস থেকে বেরোতে পারি না। ভয় হয়, না জানি সম্পর্ককে যত্ন নিতে গিয়ে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ভেবে না বসে, আবার বুঝি কোনও দরকারে এসেছে। তার চেয়ে এই বেশ ভাল আছি। ভালোবাসাটি মনেই থাকুক সসম্মানে। 

আচ্ছা, আমাদের জীবনে কী সবটা কি দরকার আর প্রয়োজন ভিত্তিক? না , নিশ্চয়ই। ছোটবেলায় পিসি বাড়ি, মাসি বাড়ি, কাকা বাড়ি যেতাম,সকলেই গেছে,  নেহাত ঘুরতে, আনন্দ করতে, কোনও দরকার ছিল না, ভালোবাসা আর আদরের বিনিময়টাই সব ছিল। আর আজ বড় হয়ে সেই একই জায়গায় দরকার ছাড়া বা কোনও আমন্ত্রন ছাড়া যাওয়া হয় না। অনেক সময় আমন্ত্রনেও যাওয়া হয় না। বিপরীত দিকের অবস্থাও একই। এটাকে অবহেলা ছাড়া কী বলব? আবার এটাও ঠিক, যে সময়ের সাথে সাথে মুখের বদল হয়, নতুন কেউ অনেকখানি জায়গা পায়, প্রায়োরিটি বদলে যায়। আর কিছু পুরোনো সম্পর্ক অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। 

 যাদের সাথে মেলামেশা, তারাও যত্ন করতে পারেনি, পারে না, সবই ক্ষণস্থায়ী বলে মনে হয়। প্রতিটি সম্পর্ককে যতটা যত্ন করা দরকার, পরিচর্যা করা দরকার, আমরা অধিকাংশই সেটা করতে পারি না, হয়ত করিও না । আর পরিচর্যার অভাবে প্রতিটি সম্পর্কই নিয়মরক্ষার উষ্ণতাবিহীন সম্পর্কে পরিনত হয়। ঠিক যেন, প্রয়োজনের তাগিদেই কিছু মানুষের একত্রিত হওয়া, সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া, কিছুকাল একসাথে অতিবাহিত করা, আবার যার যার পথ ধরে একাকীত্বের পথে পা বাড়ানো। বড়ই গোলমেলে গো, বড়ই গোলমেলে। 

অনেক বেশি বকে ফেললাম। আর, কাজ না থাকলে যা হয় আর কী! মাথার মধ্যে কত কিছু যে কিলবিল করে বেড়ায়। এতটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ দিতেই হবে, কেননা আমাদের মন এতটা সময় একজায়গায় আজকাল আর দাঁড়ায় না। ধন্যবাদ আর শুভ্রাত্রি।

Sunday, March 8, 2020

উদযাপন বিতর্ক

উদযাপন বিতর্ক 
............................ 
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই কিছু বলতে যাচ্ছি। গত কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে  যা নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেই বিকৃত চর্চা, বিকৃত প্রকাশ, বিকৃত আনন্দ আর বিকৃত উদযাপন। আবার এই বিকৃত শব্দটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, তুমি কে হে বিকৃত বলার? ঠিক কতটুকু নিয়ম ভাঙলে তাকে বিকৃত বলা যায়? এই বিকৃতির সীমারেখাই বা কে নির্ধারণ করবে? স্কুল কলজে পড়া হাজার হাজার শিক্ষিত (?) ছেলেমেয়ে যখন সমবেত ভাবে এই বিকৃতিকেই আনন্দ করে উদযাপন করছে, তখন তাদের মানসিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি। আবার সাথে সাথে এর পাল্টা প্রশ্নও ওঠে, এগুলো ঠিক করার আপনি কে? আমার আনন্দের প্রকাশ কিভাবে হবে, সেটি ঠিক করার আপনি কে? আমার শরীরে আমি কোন শব্দ লিখব, সেটি কি আপনি ঠিক করবেন? সত্যিই তো, আমরা কারা। তাহলে কে প্রশ্ন করবে?  আর যখন বৃহত্তর অংশ সংগঠিত ভাবে ভুল বিষয় উপস্থাপন করে, নিজেদের অসহায়তা সেখানে প্রকট হয়ে পড়ে। কেউ আবার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন তুললে গোলকধাঁধায়  পড়তে হয়। সমস্ত বিষয় তর্কসাপেক্ষ। 

কিন্তু বারে বারে কবিগুরুর গান বিকৃত হচ্ছে কেন? যিনি প্রথমবার গানটির মাঝে কিছু গালাগালি যুক্ত করে গেয়েছেন, তিনি অবশ্যই দোষী। তার অনেক ফলোয়ার, তাকে অনেকে সমর্থন করেন । তাকে অনেকে গালাগালি করেন, কেউ বা বলেন তাকে বোঝা নিম্ন বা মধ্যমেধার কাজ নয়। তিনি নাকি সমাজকে নতুন করে প্রতিবাদ করার পথ দেখাচ্ছেন। নতুন ভাষা , নতুন শব্দ, নতুন ভঙ্গী সৃষ্টি করছেন। সত্যিই কি তাই? হবে হয়ত। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বসন্ত উৎসব ঘিরে যে ছবিগুলো সামনে এসেছে, বেশীরভাগ মানুষই তাকে সহজভাবে গ্রহন করতে পারেননি।  না পারারই কথা। আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসবাস করেন, তার গানের কথার বিকৃতি সহ্য করা সত্যিই কঠিন। আর পাঁচজন কবি-লেখকের সাথে আমরা তাকে একাসনে রাখি না, তিনি স্বকীয়, স্বতন্ত্র। তাই ২৫ শে বৈশাখ, ২২ শে শ্রাবণ আলাদা অনুভূতিতে উদযাপিত হয়। এর ঠিক বিপরীতেও একদল আমরা আছি, যারা মনে করছি, স্বয়ং ভগবানের যখন বিকৃতি হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ যাবেন কেন? ওনার লেখা কি কারও বাপের সম্পত্তি? আমাদের বাক-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার তুমি কে হে? যেমন ভাবে খুশি গাইব, যে শব্দ আমার পছন্দ হবে সেই শব্দ বসিয়ে গাইব। বেশ, তাই হোক তবে। কিন্তু যেমন খুশি সুর আর যেমন খুশি শব্দ নিয়ে কিছু মৌলিক সৃষ্টির চেষ্টা হলে বেশী ভাল হয় না কি? অন্তত মস্তিষ্কের ভাল ব্যায়াম আর পুষ্টির যোগান হত। কিছু আমাদের এমনও মনে হয়েছে, যারা আজ গান বিকৃতি করেছে, তারাই হয়ত বড় হয়ে রবীন্দ্র-গবেষক হবে, গলা ভারী করে গান-বক্তৃতা করে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সারিতে থাকবে। খুব স্বাভাবিক। আজ আমরা যারা গেল গেল রব তুলছি, তারাই স্কুল কলেজ জীবনে কত না মজার গান বানিয়েছি, তাতে খারাপ শব্দও ছিল। ক্লাসে বেঞ্চ বাজিয়ে গেয়েওছি। তখন সেটার প্রকাশ ছিল না, প্রচার ছিল না, বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর নিজেদের কাছেও সেগুলো কখনও অশ্লীল বলে মনে হত না, বরং সেগুলো ছিল এক ধরনের গোপন আনন্দ। মজার বিষয়। আর আজকে সবাই সবার এই মজার বিষয়টিকেই নেটের জন্য জেনে যাচ্ছি আর প্রতিক্রিয়ার বহর বাড়ছে। আর যারা এগুলো করছে, তারাও যে খুব সিরিয়াসলি এগুলো নিয়ে ভেবেছে, তা মনে হয় নয়। তবে আমরা দায়িত্বশীলতা আশা করতেই পারি। তাই নয় কি? 

সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে বসন্ত উৎসবের উদ্যোক্তা রা। তাদের উৎসবের আয়োজনের কমতি ছিল না, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট খুব ভাল পারফর্ম করেছে, অনেক মানুষ প্রশংসা করেছে, কিন্তু সেগুলো কিছুই সেভাবে সাধারন লোকের সামনে আসেনি। একটি ঘটনাকে সামনে রেখে সবকিছুই চাপা পড়ে গেছে। সত্যিই দুঃখজনক।  

এর সাথে ঝড় বয়ে গেল, মালদার চার স্কুল ছাত্রীর আরও হাই ভোল্টেজ ( যদি গালাগালির শ্রেনীবিন্যাস করা হয় ) বিকৃত শব্দের মিশ্রনে গান গাওয়াকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনাতেও আমাদের বেশীরভাগ মানুষই নিন্দায় মুখরিত হয়েছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এই ভাবে বা এর থেকেও খারাপ ভাবে যে গান গাওয়া হয় না, তা কিন্তু নয়, সমস্যা প্রকাশ করাতে, মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়াতে সৃষ্টি হয়েছে। না জানি এমন কত গান, কত ভাবে প্রতিদিন রেকর্ড হচ্ছে। এটাও হয়ত নিছক মজা করার জন্যই ছিল। এক্ষেত্রেও আমরা একটু দায়িত্বশীলতা, পরিনত মনস্কতা আশা করতে পারি। তারা নেহাত শিশু নয়। আবার আমাদের মধ্যেই কিছু মানুষ বলেছি, এখন মজা করবে না তো, কখন করবে? ওরা যে শব্দে গান গেয়েছে, ওদের মুখে খুব ভাল মানাচ্ছে, লাইফটাকে এনজয় করছে, যারা খুব ভাল হয়, তাদের আর কিছু করা বা হয়ে ওঠা হয় না, এমন আরও কত কথা। ওদেরকে আমরা অনেকে সমর্থনও করেছি। তারা ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কেউ বলেছি, ওরা ভুল করেছে কিন্তু অন্যায় করেনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা যারা বড়, যারা পিতা মাতা হয়েছি, তারাও আজ বহু ধারায় বিভক্ত। এই ঘটনাগুলো কি একটু হলেও ভাবায় না? 

এই সবের মাঝে কিছু আমরা আছি, যারা নির্বিকার শ্রেণীর, সকাল থেকে সন্ধ্যা পয়সার জন্য কাজ করি, সংসার চালাই, ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা শেখাই, ঘুমিয়ে উঠে আবার কাজে যাই। কে রবীন্দ্রনাথ, কার গান কে গাইল, কে কোন শব্দ দিয়ে গাইল, কিচ্ছু লেনা দেনা নেই। কী ফেসবুক, কী হোয়াটস অ্যাপ, কার ভুলে সমাজ সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে, আদৌ কোথাও যাচ্ছে না থেমে আছে, বসন্ত উৎসব আবার কারে কয়, চাঁদ কোথায় উঠেছিল, ফেসবুক স্ট্যাটাস কারে কয়, বড় বড় বাতেলা দেওয়া কাকে বলে, কোন বাড়ির মেয়ে কোথায় কিভাবে নাচলো, ভাড়মে যা। প্রতিবাদ?  সেটা আবার কী বস? ভোর চারটেয় উঠে কাজে না গেলে ভাত জুটবে না। ওসব ফেসবুকের প্রতিবাদ নিয়ে তোরাই থাক বস। 
(কিছু কথা খারাপ ভাবে লিখে বাকস্বাধীনতা চর্চা করা হল) 

জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে যে মানুষগুলো হিমসিম খায়, তাদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো কেউ, চাঁদ না উঠলেও তাদের কিছু যায় আসে কিনা ! জিজ্ঞেস কোরো তো, বসন্ত উৎসব মানে কী? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। জাস্ট ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। তাই লড়াইটা জীবিকার জন্য হোক, বেঁচে থাকার শর্ত পূরনের জন্য হোক, আর প্রতিবাদটা অন্যায় আর অসাম্যের বিরূদ্ধে হোক।